একটি ভ্যাকসিনের গল্প
মোঃ জামাল হোসেন ।
করোনাভাইরাস পরিবারের পূর্বের সদস্যগুলো যেমন সিভিয়ার অ্যাকুয়েট রেসপিরেটরি সিনড্রোম (সংক্ষেপে সার্স) ভাইরাস, মিডল ইস্ট রেসপিরেটরি সিনড্রোম (সংক্ষেপে মার্স) ভাইরাস এবং হেপাটাইটিস, ইবোলা, ইনফ্লুয়েঞ্জা, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি রোগগুলোকে যে সকল ড্রাগ দিয়ে মোকাবিলা করা হয়েছে, সেই ড্রাগগুলোসহ বিভিন্ন অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগেরও গবেষনাগারে পরীক্ষা করা হয়েছে। কিছু কিছু ড্রাগের ক্ষেত্রে খুব ভাল ইতিবাচক ফলাফলও পাওয়া গিয়েছে। এই ক্ষেত্রে চিকিৎসার মূলভিত্তি হবে সার্স এবং মার্স ভাইরাসের চিকিৎসা পদ্ধতির মত কারন ইতোমধ্যে বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন যে কোভিড-১৯ ভাইরাসটি সার্স ভাইরাসের সাথে প্রায় ৭২ শতাংশ জিনগত মিল আছে। জিনগত মিলের ব্যপারটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যাইহোক, পৃথিবীর প্রায় ৭০ টিরও বেশি বিশ্ববিদ্যালয় বা গবেষনা সংস্থা এককভাবে বা সমন্বিতভাবে এই ভাইরাসের প্রতিষেধক বাজারে আনার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে এবং আমরা আশা করি খুব তাড়াতাড়িই সুখকর কিছু শুনব। বিজ্ঞানীদের মূল টার্গেট হচ্ছে মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি ভিত্তিক ভ্যাকসিন বাজারে আনা।
নভেল করোনাভাইরাসের পাদুর্ভাব ইতোমধ্যে আমাদের এই প্রিয় পৃথিবীর প্রায় ২০০ টিরও বেশি দেশে জ্যামিতিক হারে ছড়িয়ে পড়েছে। এই প্রাণঘাতী ভাইরাস কতটা আগ্রাসী তা সহজে অনুমেয় এর মৃত্যুর মিছিল দেখে। এই মিছিল কোথায় গিয়ে থামবে, তা এই মূহুর্তেও সঠিক ভাবে বলা যাচ্ছে না। এমন অভিজ্ঞতা পৃথিবীর কখনো হয়নি।
এই মূহুর্তে সর্বোচ্চ মৃত্যুর হার বিশ্বের সর্বাধিক শক্তিশালী দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্যে। ইরান, মালয়েশিয়া, দক্ষিন কোরিয়া এবং জাপানেও এই হার কম নয়। যদিও এই প্রাণঘাতী অনুজীবটির প্রথম আবির্ভাব হয়েছে চীনের উহান প্রদেশে ২০১৯ এর ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে। তবে চীন এই অনুজীবটির সংক্রমণের লাগাম টেনে ধরতে পেরেছে কিছু কঠোর ও কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে।
এখন পর্যন্ত এই ভাইরাস প্রতিকারের জন্য সফল কোন ভ্যাকসিন বা ওষধ অনুমোদন পায়নি। এই মূহুর্তে আমাদের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে এর সংক্রমণ রোধ করা এবং আক্রান্তদের মৃত্যুর হার কমিয়ে আনা। ডাব্লিউএইচও এই ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে লকডাউনসহ কিছু উপায়ও বলে দিয়েছেন এবং পৃথিবীর সবগুলো দেশকেই কার্যকর এই পদক্ষেপগুলোকে মেনে চলারও পরামর্শ দিয়েছেন।
সাধারণত একটি ড্রাগ বা ভ্যাকসিনের রুপরেখা তৈরি, প্রিক্লিনিক্যাল, ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালসহ বাজার পর্যন্ত আসতে কমপক্ষে কয়েক বছর সময় লাগে। এই ক্ষেত্রে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালেই সময়টা বেশি লাগে। এটি বেশ জটিল এবং সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি যেমন সময় সাপেক্ষ তেমনি দরকার বিপুল পরিমান অর্থ।
এই অবস্থায় সারা বিশ্বব্যাপী গবেষকরা আমাদের বিদ্যামান ড্রাগগুলো নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করে দিয়েছেন। এটা রিপার্পাসিং স্ট্রেটেজি বা বিদ্যমান এমন কোন চিকিৎসা পদ্ধতি করোনার বিরুদ্ধে কার্যকরি করে তোলা, যেটা খুব তাড়াতাড়ি বাজারে আনা সম্ভব। এই পদ্ধতির সুবিধা হচ্ছে এর অনুমোদন পাওয়ার জন্য সময় কম লাগবে এবং এর সেইফ্টি প্রোফাইল নিয়ে খুব একটা চিন্তা করতে হবে না।
![]() |
পরীক্ষামূলক ভ্যাকসিন প্রয়োগ চলছে |
করোনাভাইরাস পরিবারের পূর্বের সদস্যগুলো যেমন সিভিয়ার অ্যাকুয়েট রেসপিরেটরি সিনড্রোম (সংক্ষেপে সার্স) ভাইরাস, মিডল ইস্ট রেসপিরেটরি সিনড্রোম (সংক্ষেপে মার্স) ভাইরাস এবং হেপাটাইটিস, ইবোলা, ইনফ্লুয়েঞ্জা, ম্যালেরিয়া ইত্যাদি রোগগুলোকে যে সকল ড্রাগ দিয়ে মোকাবিলা করা হয়েছে, সেই ড্রাগগুলোসহ বিভিন্ন অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগেরও গবেষনাগারে পরীক্ষা করা হয়েছে। কিছু কিছু ড্রাগের ক্ষেত্রে খুব ভাল ইতিবাচক ফলাফলও পাওয়া গিয়েছে। এই ক্ষেত্রে চিকিৎসার মূলভিত্তি হবে সার্স এবং মার্স ভাইরাসের চিকিৎসা পদ্ধতির মত কারন ইতোমধ্যে বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন যে কোভিড-১৯ ভাইরাসটি সার্স ভাইরাসের সাথে প্রায় ৭২ শতাংশ জিনগত মিল আছে। জিনগত মিলের ব্যপারটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যাইহোক, পৃথিবীর প্রায় ৭০ টিরও বেশি বিশ্ববিদ্যালয় বা গবেষনা সংস্থা এককভাবে বা সমন্বিতভাবে এই ভাইরাসের প্রতিষেধক বাজারে আনার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে এবং আমরা আশা করি খুব তাড়াতাড়িই সুখকর কিছু শুনব। বিজ্ঞানীদের মূল টার্গেট হচ্ছে মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি ভিত্তিক ভ্যাকসিন বাজারে আনা।
প্রথমদিকে চায়নিজ বিজ্ঞানীরা এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রায় ৩০ টি বায়োলজিক্যালি সক্রিয় এবং ট্র্যাডিশনাল কিছু ওষধের উপর পরীক্ষা চালান। স্যাংহাইটেক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা বড় অর্জন ছিল তারাই প্রথম এই নভেল অনুজীবটির টার্গেট প্রোটিনের (ভাইরাল প্রোটিয়েজ-এমপ্রো) স্ফটিক গঠন আবিষ্কার করেন যা এই ভাইরাসের প্রতিলিপিকরণ নিয়ন্ত্রণ করে। এই টার্গেট প্রোটিনের সাহায্যেই বিজ্ঞানীরা খুব দ্রুতই কম্পিউটার ভিত্তিক ভার্চুয়াল স্ক্রিনিং করা শুরু করেন এবং সম্ভাব্য ড্রাগগুলো অনুধাবন করেন।
কোভিড-১৯ উহান প্রদেশে যখন লাগামহীন হয়ে যাচ্ছিল তখনই চায়নার ন্যাশনাল মেডিক্যাল প্রোডাক্টস অ্যাডমিনিশট্রেশন এই ভয়াবহ অবস্থা থামানোর জন্য ফ্যাবিপিরাভির নামক একটি অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগের জাতীয় অনুমোদন দিয়ে দেয়।
ফ্যাবিপিরাভির হচ্ছে নিউক্লিওসাইড অ্যানালগ যা ইনফ্লুয়েঞ্জা, ইবোলা, চিকুনগুনিয়া, নরোভাইরাস, অ্যান্টারোভাইরাস ইত্যাদির বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী অনুমোদিত একটি ড্রাগ। উহান এবং শেনযেনে মোট ৩৪০ জন করোনা আক্রান্ত রোগীর উপর একটি ট্রায়ালে এটি খুবই কম প্বার্শপ্রতিক্রিয়াসহ এর ফলপ্রসূতা দেখায়। তবে এটি খুবই ক্রিটিক্যাল ও জটিল রোগীদের ক্ষেত্রে খুব একটা ফলপ্রসূতা দেখাতে পারেনি।
আরেকটি সম্ভাব্য নিউক্লিওসাইড অ্যানালগ ভিত্তিক অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ হল রেমডিসিভির। এটিও সার্স এবং মার্স ভাইরাসের মত রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড (আরএনএ) ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকরি একটি ড্রাগ যা বিভিন্ন কৃত্রিম কালচার এবং প্রাণী মডেলের উপর পরীক্ষিত। আমেরিকাতে একজন কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত ব্যক্তি এই ড্রাগ নিয়ে খুব ভালভাবেই সুস্থ হয়েছেন বলেও একটি সায়েন্টিফিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
রেমডিসিভির এর মত গালিডেসিভির আরেকটি অ্যান্টভাইরাল ড্রাগ যার এখন প্রারম্ভিক ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে। এটিও সার্স এবং মার্স ভাইরাসের মত বিভিন্ন আরএনএ ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকরি যা প্রিক্লিনিক্যাল পরীক্ষাগুলোতে প্রমাণিত হয়েছে। আরএনএ অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগগুলো সাধারণত আরএনএ পলিমারেজ এনজাইমগুলোকে নিষ্ক্রিয় করে দেয় এবং ভাইরাসগুলোর প্রতিলিপিকরণে বাধা সৃষ্টি করে।
আরও একটি খুবই সম্ভাব্য চিকিৎসা হচ্ছে রিটোনাভির এবং লোপিনাভির এর কম্বিনেশন থেরাপি। এরা সাধারণত এইচআইবি চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। এই কম্বিনেশনটি সার্স এবং মার্স ভাইরাসের বিরুদ্ধে ফলপ্রসূতা দেখিয়েছে। তবে উহানে এর ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে তেমন কোন সন্তোষজনক ফলাফল পাওয়া যায়নি।
লোপিনাভির/রিটোনাভির, রিভাবিরিন এর সাথে ইন্টারফেরন বিটা-র কম্বিনেশনে আরেকটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হয়েছে। তবে কোন কোন বিজ্ঞানীরা বলেছেন এই পদ্ধতি সঙ্কটাপন্ন রোগীদের ক্ষেত্রে খুবই বিপদজনক এবং এর প্বার্শপ্রতিক্রিয়া নিয়ে খুবই চিন্তিত।
যারা করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর সুস্থ্য হয়ে ফিরেছেন, তাদের দেহে এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে সক্রিয় অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। তাদের থেকে রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে অ্যান্টিবডি ভিত্তিক ভ্যাকসিন তৈরির পদ্ধতিটিও বিজ্ঞানীদের কাছে জনপ্রিয় হচ্ছে। করোনাভাইরাস হতে বেঁচে ফিরে আসা ব্যক্তির অ্যান্টিবডি আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে প্রবেশ করালে তার দেহের ভিতর এক ধরনের প্যাসিভ ইমিউনিটি বা অসার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি হয়ে যায়। অচিরেই ভাইরাস থেকে নিজেকে রক্ষা করার কৌশল দেহের কোষগুলো শিখে ফেলে এবং শত্রুপক্ষকেও ধ্বংস করার যুদ্ধ শুরু করে দেয়। এই পদ্ধতি অবলম্বন করে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে ভ্যাকসিন তৈরির গবেষনা ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে।
সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী ক্লোরোকুইন এবং হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খুব আলোচনা দেখেছি। অনেকেই না বুঝে ভুল তথ্যও প্রকাশ করতে দেখেছি। আগেই বলে রাখি ক্লোরোকুইন জাতীয় ওষধগুলো ম্যালেরিয়া রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। চায়না এবং ফ্রান্সের কিছু ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে ছোট পরিসরে হলেও এটি করোনাভাইরাস প্রতিকারে ভূমিকা রেখেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট একবার জনসম্মুখে এর সুফল সম্পর্কে বলেছেন। যদিও তিনি এই ওষধের ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া স্বচিকিৎসা করতে নিরুৎসাহিত করেছেন।
আসলে ক্লোরোকুইন বা হাইডোক্সিক্লোরোকুইন যেই মাত্রায় করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে ক্রিয়া দেখিয়েছে তার প্বার্শপ্রতিক্রিয়া অনেক বেশি। এটি স্বাভাবিক হৃদক্রিয়ার ব্যাঘাত ঘটায়। এমনকি মৃত্যুরও কারণ হতে পারে। হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন ড্রাগটি অ্যাজিথ্রোমাইসিন আন্টিবায়োটিকের সাথে করোনাভাইরাসটির উপর যে ফলপ্রসূতা দেখিয়েছে তা খুবই অল্প মানব শরীরেই প্রয়োগের উপর ভিত্তি করে প্রকাশিত নিবন্ধ ছিল। ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) এখনও এর অনুমোদন দেননি। অনুমোদন প্রাপ্ত হলে এই ড্রাগের সব চাইতে বড় সুবিধা হবে এই ড্রাগটি খুবই সস্তা এবং অধিকাংশ দেশেই এর সহজ সূত্রবদ্ধকরণ করা সম্ভব।
যাই হোক, অদূরবর্তী এই ভয়াবহ বিপদ হতে বাঁচতে হলে ডাব্লিউএইচও কর্তৃক পরামর্শ এবং আমাদের সরকারের নেওয়া পদক্ষেপগুলো প্রত্যেক নাগরিককে অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতে হবে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, খুব প্রয়োজন না হলে বাইরে বের না হওয়া, নিয়মিত হাত ধোঁয়াসহ সকল গৃহীত পদক্ষেপসমূহ আরো জোরদার করতে হবে।
পাশাপাশি বিজ্ঞান কিংবা বিজ্ঞানীরা আমাদের আশার আলো দেখাচ্ছেন, কাজ করে যাচ্ছেন দিনরাত আমাদেরকে একটি সফল চিকিৎসা উপহার দেয়ার জন্য। আমরা অচিরেই আমাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাব, দূরত্বে না থেকে আমরাও আমাদের আপনজনদের, বন্ধু কিংবা স্বজনদের বুকে টেনে নিতে পারব। এমন আশা কি আমরা করতে পারি না?
লেখকঃ ফার্মাসিস্ট, গবেষক ও সাবেক শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
Email: jamal.du.p48@gmail.com
পূর্বপশ্চিম বিডি ডট নিউজে প্রকাশিত।
No comments